মৃত্যুর দুয়ার
আহত কথাটা যদি শুধুমাত্র একটি শব্দের মাঝে বেঁধে রাখা হয়, তাহলে আহতের অর্থকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে এখানে লিখে উপস্থাপন করা পুরোটাই সম্ভব নয়। তারপরও যতটুকু পারা যায় চেষ্টা করব।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয় কোটা নামক এক জালিয়াতি দূরীকরণের জন্য। গত ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেয়।এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। আর ওই দিনেই সরকারের পা চাটা গোলাম পুলিশ এবং ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। এসব হামলায় ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের ওপর এই অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন চোখে দেখার মতো ছিল না। শিক্ষার্থীদেরকে ধরে ধরে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল। তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র দিয়ে তাদের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে দেওয়া হয় । আরো বিভিন্নভাবে তাদের উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন করা হয়। আমি একজন শিক্ষার্থী হয়ে কিভাবে অন্য শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের ওপর এইকম অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে পারি? না। আমি পারিনি, আমি সহ্য করতে পারিনি তাদের উপর হওয়া এই জুলুম, নিপীড়ন।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, “এই সময় ঘরে বসে থাকার সময় নয়, এই সময় জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময়।”আমাদের মাদ্রাসায় তখন বর্ষ-সমাপনী পরীক্ষা চলতেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে, “ছাত্র ভাইয়েরা আমাকে ডাকছে!” ছাত্র ভাইদের “ আর্তনাদ”আমাকে ডাকছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা গত ১৮ জুলাই সকাল ১১:০০ টায় উত্তরা বি এন এস ৬ নং সেক্টরে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীগণ, নানা পেশার মানুষ ও সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে ময়দানে পদার্পণ করলাম কোটা নামে জালিয়াতি দূরীকরণের জন্য এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি হওয়া জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। সকাল ১০ টায় পুলিশ বাহিনী, বিজিবি,র্যা ব ছাত্রলীগ এবং তাদের দলবল সহ, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রনিয়ে রাস্তায় নামে। আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করতেছিলাম। সেই সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছিলাম “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার”“কোটা না মেধা? মেধা, মেধা। ” কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে, লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।অথচ আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে কোন কিছুই ছিল না তাদের প্রতিহত করার জন্য। নিরুপায় হয়েও আমরা তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম।বেলা ১২ টার দিকে আমার মাদ্রাসার এক সিনিয়র ভাইয়ের চোখে এসে ছররা গুলি লাগে।
তিনি অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বললেন না “আমি এখানে আন্দোলন করবো,হাসপাতালে যাবো না।” কিন্তু আমরা তাকে তার শরীরের অবস্থা বুঝিয়ে হাসপাতালে রেখে আসলাম। ফিরে আসার একটু পরে তিনটি ছররা গুলি আমার গায়ে এসে লাগে। আঘাতের মাত্রা অত্যাধিক না হওয়ায় আমার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। তারপরও আন্দোলনের সঙ্গে থেকেছি।পুলিশ আমাদের উপর অনবরত ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড,কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে ছিল। আমাদের পাশেই ফ্লাইওভার ছিল, সেই ফ্লাইওভারে আমাদের ছাত্র ভাইদের আরেকটি গ্রুপ ছিল। পুলিশির বাহিনী তাদেরকে আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে দিচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পুলিশের ধাওয়ার কারণে আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। বার বার কাঁদানে গ্যাস চোখে, নাকে, মুখে আসার কারণে চোখ খুলে দেখতে পারতাম না যে আসলে রাস্তা কোথায়? কিছুক্ষণের ভিতরেই আমার শরীর খারাপ হয়ে আসে। এজন্য চোখে আগুনের তাপ দিয়েছিলাম, যাতে করে কাঁদানে গ্যাস এর প্রভাব চলে যায়।
পুনরায় রাস্তায় আসলাম।আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম দুইজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষার্থীকে নিজের কোলে করে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তার ঘাড়ে গুলি লেগেছিল। সেখান থেকে শুধু রক্ত পরতে ছিল অনবরত। বিভিন্ন ধোয়ার কারণে এলাকা পুরো অন্ধকার হয়ে আসতেছিল। দেখে যেন মনে হচ্ছিল এ যেন এক ভয়ঙ্কর রণক্ষেত্র! রাস্তার পার্শ্বে ছোট দোকান ছিল। সেখান থেকে দোকানের টিন নিয়ে এসে ছাত্রজনতা সেই খুনি হাসিনার পা চাটা গোলাম পুলিশের মোকাবেলা করতে ছিল। কিছুক্ষণ পর পরই আমরা একটি করে লাশ দেখতে পেতাম। মাঝে মাঝে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তাম। এটা কি কোন দেশের সরকারের কাজ হতে পারে?চিন্তা করতে পারিনি যে, এই ময়দান থেকে ফিরে যেতে পারব কি? না। পুলিশ আমাদের উপর আবার অতর্কিত হামলা চালায়। সেখানকার স্কয়ার হাসপাতালের পার্শ্ব রাস্তা দিয়ে আমাদেরকে ভেতরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ দেখতে পেলাম আমাদের প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্র! তাদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হলাম। এক পর্যায়ে বিশ্ব রোড থেকে অনেকটা ভিতরে চলে আসছিলাম। সেখানে একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে আমরা সেখানে জোহরের নামাজটি আদায় করে নেই।
সেখানে সাধারণ দোকানদাররা আমাদেরকে বলতেছিল, বিস্কিট, পানি খাও, কুশারের রস খেয়ে যাও শক্তি পাবা। মনে হচ্ছিল তারা যেন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক।তারা ভাবেনি এতে তার লস হবে কি? না। ৫ আমরা আবারও অগ্রসর হলাম।এক পর্যায়ে পুলিশের যখন গুলির বুলেট শেষ হয়ে যায়। তখন তারা ছাত্র জনতার কাছে আত্মসমর্পণ করে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল বিজিবি এবং র্যা ব। এমতাবস্থায় আমরা পুলিশের উপর কোন প্রকার আক্রমণ করিনি। তাদের যখন গুলিতে বুলেট লোড করে নেয়া হলো তারা আমাদের ওপর আবার সেই একই নিয়মে গুলি করতে লাগল। তখন ছাত্র জনতা এবং পুলিশ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। যখন গুলি চালাচ্ছিল তখন শিক্ষার্থীরা পালানোর চেষ্টা করতেছিল। এমতাবস্থায় অনেকের বুকে, অনেকের পিঠে, অনেকের মাথায় গুলি লাগে। তারা ওই মুহূর্তে সেখানে শাহাদত বরণ করেন।
অনেকে গুরুতরভাবে আহত হন। আমরা তাদের কে নিয়ে আসতে গেলে তারা আমাদেরকে বাধা প্ৰদান করে। তারপরও তারা আমাদের ছাত্রজনতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা আবারও সেই টিন দিয়ে, আর যাই দিয়ে হোক তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছু সংখ্যক ছাত্র-জনতা কলোনির রাস্তার দিকে আসলাম। সেখানে অনেক ছাত্র ভাইয়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আমরা তাদের বললাম কি হয়েছে? তারা বলল আমাদের উপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে, ছাদের উপর, ও বিল্ডিং এর বিভিন্ন তলায়। তাদের সাহায্যের জন্য অনেক শিক্ষার্থী এগিয়ে গেল। কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা গেল। ৫ বিকাল তিনটার দিক থেকে পুলিশের গুলি চালানোর মাত্রা তীব্র থেকে তীব্র তর হয়। তারা তখন রাবার বুলেট, ছররা গুলি এগুলো চালিয়েও থেমে থাকেনি, তারা সীমান্তে ব্যবহৃত স্নাইপার গুলির বুলেটও অতিমাত্রায় প্রয়োগ করেছে।সকাল ১২ টায় যেই সিনিয়র ভাইটির চোখে গুলি লেগেছিল,সেই ভাইটি আবারও মাঠে নেমেছিল।পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে আসতেছিল। সেখানকার একটি বিল্ডিং এর ছাদও বাকি যায়নি যেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিল না! এমনকি উত্তরা পূর্ব থানার ছাঁদে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতারা সেখানে অবস্থান করতেছিল।
তারা ছাঁদ থেকে আমাদের উপর গুলি করতেছিল এবং সাউন্ড গ্র্যেন্ডেট দিয়ে আমাদের আতঙ্কের মাঝে রাখার চেষ্টা করতেছিল। বেলা ৪ টার দিকে তাদের গুলির বুলেট পুনরায় শেষ হয়ে গেলে তারা আগের মতই ছাত্র জনতার কাছে আত্মসমৰ্পণ করে। কিন্তু এবারও তারা মীর জাফরের মত বিশ্বাসঘাতকতা করে অসংখ্য মায়ের বুককে খালি করে। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগীর সংখ্যা এত পরিমান বেশি ছিল যে, তারা প্রাথমিক চিকিৎসাটাও দিতে পারতে ছিল না। হাসপাতালের বারান্দায় শুইয়ে রেখে তাদের অপারেশন করা হচ্ছিল। সময় গড়াতে গড়াতে বাজলো বিকেল ৫ টা। তাদের এই ম্যাসাকার এর মাত্রা এত পরিমাণ বেশি ছিল যে রাস্তায় দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। ৭ আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা সবাইকে একত্রিত করতে ছিল ফিরে যাওয়ার জন্য। আমরা দুইজন শেষবারের মতো পরিস্থিতি দেখার জন্য আজমপুর ওভার পাস এর নিচে অবস্থান নিলাম ।
এরই মাঝে হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছিলাম এটা আসল গুলির বুলেট। শব্দ শোনা মাত্রই যখন ঘুরে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ঠিক ওই মুহূর্তেই উত্তরা পূর্ব থানার ছাঁদ এর ওপর থেকে দ্বিতীয়বারের মতো করা ছাত্রলীগের স্নাইপার গুলির বুলেট হঠাৎ করে আমার হাতে এসে লাগে এবং হাত এর একপার্শ্বে ছিদ্র হয়ে হাতের অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে, বুকের নিচে লাগে। আমার সহপাঠী আমাকে বলল, “গুলি লেগেছে! " তখন কথা বলতে পারছিলাম না।আমি মাথা নাড়ালাম । তখন সে বুঝতে পারল যে, আমার গুলি লেগেছে। তখন সে বলল, “এখানে থাকা যাবে না, চলো। "কারণ তখন তারা লাগাতার দশটি স্নাইপার গুলি চালিয়েছে। আমার পাশে এক বৃদ্ধ লোক ছিল, তার মাথায় গুলি লেগে তিনি ওখানে শহীদ হন ।
তখন গুলি লাগা স্থানে বাম হাত দিয়ে সহপাঠীর সঙ্গে দৌড়াচ্ছিলাম। প্রায় ৫০ মিটার দৌড়ের পর আর দৌড়াতে পারতেছিলাম না।মাত্রাতিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এবং পেটের নাড় দশ জায়গায় ফুটো হয় এবং হাতে গুলি লাগার কারণে হাতের রগ ছিড়ে যায়। তখন শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতেছিল। মাটিতে লুটাইয়া পড়ার সময় সেখানকার কয়েকজন মিলে আমার হাত পা ধরে নিয়ে যায় অনেকটা জায়গা। সেখানে মেডিকেল টিমের লোকেরা আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় এবং একটি শার্ট দিয়ে আমার পেট বেধে দেয়া হয়।সেখান থেকে আমাকে রিক্সা করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এত পরিমাণে রোগী ছিল যে,কাকে ছেড়ে কাকে চিকিৎসা দিবে তারা বুঝতেছিল না? আমাকে একটি বিছানায় শোনানো হয়। প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার বিছানায় আর একজন গুলিবিদ্ধ রোগীকে শোয়ানো হয়। তখন আমার বেডের নিচে একটি লাশ পড়েছিল।
ডাক্তার বললেন আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে। তাই আমার সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাইয়েরা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে গেলেন। কিন্তু ডাক্তাররা এই আশঙ্কা করলেন যে, ঢাকা মেডিকেল যেতে যেতে আমি আর হয়তোবা বাচবো না? তাই তারা তাৎক্ষণাত আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। আমার অনেক আগে থেকেই প্রসাবের চাপ আসতে ছিল। তাই আমি তাদেরকে বললাম, তখন তারা একটি হুইল চেয়ারে করে আমাকে নিয়ে যায় প্রসাব করানোর জন্য। অনেকক্ষণ পর অনেক কষ্ট করে প্রসাব করলাম। তারপর তারা আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। তখন হাতের অপারেশন এর চেয়ে পেটের অপারেশনটা অনেক জরুরী ছিল। তাই তারা আমার পেটে একটি ইনজেকশন পুশ করায়, অবশ করার জন্য। হালকা একটু অবস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেখান দিয়ে পেটে বুলেট ঢুকেছিল ওইখানে কাটে। তারপর ডাক্তার তার আঙ্গুল দিয়ে বুলেটটি খুজতেছিল।
তারা সেখানে বুলেটটি না পেয়ে সেলাই করে দেয়। তখন আমাকে ডাক্তার বললেন যে, মানুষের শরীরে মেটাল থাকে। তাই বুলেট না বের করলে সমস্যা নেই। তারা বুলেটটি বের করতে সেখানে অপারগ হন। তারপর আমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। তখনও আমার সহপাঠীরা এম্বুলেন্স খুঁজতে ছিল,কিন্তু পাচ্ছিল না।তারা হঠাৎ একটি অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে উঠতে বলল। আমাকে তারা এম্বুলেন্সে ওঠায়। এম্বুলেন্সের ড্রাইভারটি আসতে অনেক দেরি করতে ছিল। পেটের ভিতরের নাড় ফুটো হয়ে যাওয়ার কারণে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে তিনবার রক্ত বমি করি। এম্বুলেন্সে আমার সঙ্গে আমার সহপাঠীরা ছিল।
তারা আমার এই বমি করা দেখে তাদের মধ্যে অনেক ভীতির সঞ্চার হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার আসলো। বিশ্ব রোড নিরাপদ না হওয়ায় ড্রাইভার আমাদেরকে বিভিন্ন পকেট রাস্তা দিয়ে কুর্মীটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কর্মীরা আমাকে একটি বেডে করে তৎক্ষণাৎ অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। পুরো শরীরের কাপড় রক্ত দিয়ে ভিজে যাওয়ার কারণে, সেখানে আমার পুরো শরীরের কাপড় কেটে ফেলে দেয়া হয়,একটি হাফপ্যান্ট ব্যতীত। মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় তারা আমার শরীরে ৬ ব্যাগ রক্ত দেয়। শরীরের তাপমাত্রা অনেক কমে আসতেছিল, তার উপরে ছিল এসি রুম। ঠান্ডাতে বেডের উপরে থরথর করে কাঁপতে ছিলাম। ১০ তখন ডাক্তাররা আমার হাতে বিভিন্ন প্রকার মেডিসিন দিয়ে হাত পরিষ্কার করেন। তখন আমার হাতটা একটু উপরে তুলে দেখলাম যে, হাতের এই পাশ থেকে ওই পাশ দেখা যায়। হাতে ব্যান্ডেজ থাকার কারণে এর আগে হাতটি দেখার সুযোগ হয়নি। তখন থেকে আমার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো সোজা করতে পারতেছিলাম না।
ডাক্তার বললেন, “আঙ্গুল সোজা করো দেখি! ”কিন্তু হাতের রগ ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে আমি আঙ্গুলগুলো সোজা করতে পারিনি। তখন ডাক্তাররা বললেন যে, আমার Ulnar Nerve Injury হয়েছে। তারপর তারা আমার হাতে বিভিন্ন মেডিসিন দিয়ে দেয়। গজ দিয়ে হাতের ফাঁকা অংশগুলি ঢেকে দেয়। প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছিল তারপরও তারা অনেক জোরে জোরে চেপে দিচ্ছিল কারণ সেখানে মাংস ছিল না। তারপর তারা আমার ডান হাতকে প্লাস্টার করে দেয়। এটি ছিল দ্বিতীয় অপারেশন। তারপর তারা আমাকে অন্য একটি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। এবারের অপারেশনটা ছিল পেটের।অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার মুখে একটি অক্সিজেন মাক্স পরিয়ে দেয়৷ অপারেশনের জন্য অজ্ঞান করলে পরবর্তীতে জ্ঞান ফিরবে কি? না।এই আশঙ্কা থাকায় প্রথম দুটো অপারেশনে তারা কেউ ই আমাকে অজ্ঞান করায়নি। এবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা নির্দিষ্ট কাগজে স্বাক্ষরের মাধ্যমে অজ্ঞান করার অনুমতি নেয়।তারপর তারা আমাকে একটি ইনজেকশন পুশ করায় আমি অজ্ঞান হয়ে যায়।
১১ আমাকে মোট ছয় ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিল। আমার সহপাঠীরা প্রথম অপারেশনের সময়েই আমার মা-বাবাকে এই বিষয়ে অবগত করেছিল। রাস্তায় নিরাপদ না থাকায় তারা আমার কাছে ঐদিন আসতে পারেননি।আমার আপন চাচা ঢাকায় থাকে।তার কাছে খবরটি গেলে তিনি আমার কাছে চলে আসেন। যখন আমাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন থেকে তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন। রাত ১০ টায় আমাকে পেটের অপারেশনের জন্য ঢুকানো হয় । এবং তারা রাত ২ টার সময় আমাকে সেখান থেকে বের করে। অজ্ঞান থাকায় এই সময়ের ঘটনার কথা আমি বলতে পারিনা। তবে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আমার চাচা ও সহপাঠীরা এই সময়ের ঘটনা আমাকে যেভাবে অবগত করেছিল, আমি সেই ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। হাসপাতালে আমার বুকের একটি এক্স-রে করানো হয়েছিল। এক্স-রে রিপোর্টে বুলেটটি যেখানে দেখাচ্ছিল, তারা সেখানে কেটেছিল।
তবে দুর্ভাগ্যবশত তারা সেখানে একটি বুলেটটি পায়নি। প্রথম অপারেশনের সময় পেটের ডান পার্শ্বে যেখানে কাটা হয়েছিল,তারা দ্বিতীয়বারের মতো সেই ক্ষত স্থানে আবারও অস্ত্রপ্রয়োগ করে বুলেটটি বের করার জন্য। কিন্তু তারা সেখানেও ব্যর্থ হয়।এবার ডাক্তার আমাকে ওপেন হার্ট সার্জারির মতো, বুকের নিচ থেকে পেটের নাভির নিচ পর্যন্ত কাটে। ১২ তখন তারা সেখানে দেখতে পারেন যে, আমার পেটের নাড় ১০ জায়গায় ফুটো হয়। তাই তারা ৩ টা স্যালাইন দিয়ে আমার পেটের যাবতীয় সবকিছু পরিষ্কার করে দেন। তারা হতভঙ্গ হয়ে টানা দুই থেকে তিন ঘন্টা শুধু পেটের ভেতরে বুলেটটা খুঁজতে ছিল এ পাশ-ওপাশ করে।
একপর্যায়ে গিয়ে তারা তল পেটের পিছন দিকে গিয়ে বুলেটটি পেতে সক্ষম হন।যেহেতু হাসপাতালটি সেনাবাহিনীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তারা বুলেটটি দেখেই শনাক্ত করতে পারেন যে, এটা সীমান্তে ব্যবহৃত বিজিবি এর স্নাইপার গুলির বুলেট ।তারা বুলেটটা তাদের নিজের কাছে রেখে দেয়। অপারেশনে তারা আমার মুখ থেকে পেট পর্যন্ত একটি নল ঢুকিয়ে দেয়, প্রসাবের নালিতে একটি পাইপ ও পেটের দুই পাশে দুইটা পাইপ সেট করে দেয় তারা। যাবতীয় কাজ শেষ করে আমাকে রাত দুইটার সময় অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে ICU তে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর আমার হালকা জ্ঞান ফিরতে ছিল,সেখানে একটি নার্স আমাকে বলেছিল যে,“দেখি সোজা হয়ে বসো তো!” কিন্তু আমার তো তখন উঠে বসার মত শক্তি ছিল না। তবুও কেন জানি তিনি আমাকে ধরে উঠিয়ে বসিয়েছিলেন? যাহোক, কিছু সময় পর ঘুমিয়ে গেলাম। বাম হাতে স্যালাইন ফুরানো ছিল, আর ডান হাত ছিল প্লাস্টার করা। নিজ হাতে কোন কিছু করার মত সামর্থ্য ছিল না। ডান হাতটি বুকের উপর দিয়ে ঘুমানোর কারণে বুক ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। ১৩ নার্সকে বলায় নার্স আমার হাতকে একটা ভালো পজিশনে রেখে দেন। ২ ঘন্টা পর পরে নাক দিয়ে পেটের ময়লাগুলো টেনে বের করতো। এতে খুব একটা কষ্ট হতো না।
দুই দিন ICU তে থাকার পর আমাকে ওয়ার্ডে রাখা হলো। ওয়ার্ডে গিয়ে আমার অনেক পেট ব্যথা করতেছিল। ডাক্তার পরিদর্শনে আসলে, আমি তাকে বললাম পেট ব্যথার কথা! তখন ডাক্তার আমাকে সাপোজিটারি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তো সেটা নিচ্ছিলাম। আমার অনেক পানির পিপাসা পেয়েছিল। ডাক্তার বলেন, “৫ দিন পর পানি খাবা”। পিপাসা লাগা সত্ত্বেও কিছু করার নেই। তাই কষ্ট করে হলেও সহ্য করতে ছিলাম। আমাকে যে বিছানায় রাখা হয়েছিল একটা কর্ণারে। সেখানে ফ্যানের বাতাস ভালো লাগতেছিল না। তাই সেই বিছানা পরিবর্তন করে ওই ওয়ার্ডের অন্য পার্শে গিয়ে একটা ভালো জায়গায় অবস্থান নিলাম। আমার সহপাঠীরা আমার সঙ্গে সব সময় ছিল। আমার চাচা সকালবেলা এবং অফিস করে এসে আমার সঙ্গে ছিলেন। রাস্তা অনিরাপদ সত্বেও আমার বাবা শত বাধা অতিক্রম করে তিনদিন পর আমার কাছে চলে আসেন।
তখন কারফিউ জারি করা হয়েছিল। আমি একটিবারের জন্য ভাবতে পারিনি যে,সেই কলিজার মা-বাবার মুখটা দেখতে পারবো কিনা আর কখনো? আমার আহত হওয়ার কথা শুনে আমার মা হাউ মাউ করে কাঁদিতেছিলেন। ১৪ আমার বাবা আসায় আমার চোখ থেকে গড় গড় করে পানি পড়তে লাগলো। কোন রকম নিজেকে সামলে বাম হাতটা একটু উঁচু করে বাবাকে ডাক দিলাম। বাবার চোখ ছিল কান্না বিজরিত চোখ। তারপরও তিনি আমাকে দেখে নিজেকে সামলে নেন।বাবাকে দেখে অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারতেছিলাম। মনে প্রশান্তির অনুভব হচ্ছিল। তিনি আসার পর থেকে আমার দেখাশোনা শুরু করেন। একাই সব কিছু করা সম্ভব না,যার কারণে আমার সহপাঠীদেরও আমি এবং আমার বাবার সঙ্গে হাসপাতালে অত্যন্ত কষ্ট করে রাত্রি যাপন করতে হয়েছে। আমার হাতে সব সময় স্যালাইন ফুড়ানো থাকতো।
একটি শেষ না হতেই আরেকটি স্যালাইন দিয়ে দিত। হাসপাতালের এক একটি দিন যেন এক একটি বছরের সমান মনে হচ্ছিল। আমার নাক দিয়ে পাইপ থাকায়, সব সময় চিৎ হয়ে শুয়ে বাম পাশ হয়ে থাকতে হতো।কারণ যখনই ডান পাশ হতে যেতাম তখনই মনে হয়েছিল যেন পেট থেকে সব মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে। যার ফলে বাম পাশ হয়ে থাকার কারণে আমার বাম কানটা প্রচুর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। সব সময় চিৎ হয়ে থাকার কারণে আমার পিঠ, কোমর, এত পরিমান ব্যথা হয়ে যেত যে, পাঁচ মিনিট পরপরই আমাকে ধরে উঠিয়ে বসে পিঠে এবং কোমরে হাত দিয়ে দাবা দিতে হতো। শুয়ে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা হয়ে যায় এই কারণে আমাকে ধরে উঠিয়ে বসে আমার পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়ে অন্য একজন ধরে রাখা লাগতো। ১৫ প্রচন্ড ব্যাথার কারণে সকাল সন্ধ্যা আমার গায়ে অনেক পরিমাণে জ্বর আসতো। প্রতিদিন জ্বরের পরিমাণ ছিল ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রী করে। পাঁচদিন অতিবাহিত হবার পর যখন ডাক্তার পরিদর্শনে আসলেন, আমি ডাক্তার কে বললাম, “ ডাক্তার আমি কি এখন পানি খেতে পারবো? ”ডাক্তার বললেন, “পানি খেয়ে কি করবা? পানির জন্য মনটা অনেক ছটফট করতে ছিল। ডাক্তারের এরকম কথার প্রত্যাশা আমি কখনো করিনি! আল্লাহর উপর ভরসা করে, মনের মধ্যে সব কষ্ট লুকায় রেখেছিলাম। শুধু ভাবতেছিলাম আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে দিকে নিয়ে যাবে, আমি সেই দিকেই যাব। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে দিন পার করতেছিলাম।
আমাকে দেখার জন্য আমার আত্মীয়-স্বজনরা আসতেন। অনেক সহপাঠীরা আসতেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে আমাকে দেখার জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের এক সিনিয়র ভাই এসেছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে আসেন,ফিরে যাওয়ার পথে আব্দুল্লাহপুরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আমার কথা হচ্ছে, সেই ভাইটির দোষ কি ছিল? যে কিনা আমাকে দেখতে এসেছিল। অথচ ফিরে যাওয়ার পথে একজন নির্দোষ লোককে কিভাবে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে? পুলিশ নাকি জনগণের বন্ধু? কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্ট ভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছিল পুলিশের আসল পরিচয় কি? ১৬ এই কঠিন,ভয়াবহ পরিবেশের মধ্য দিয়েও আমার সহপাঠীরা,সিনিয়র ভাইয়েরা এবং অন্যান্যরা আমাকে দেখতে আসতেছিলেন।আমার প্রসাবের নালীতে পাইপ থাকায় প্রসাব করতে অনেক কষ্ট হতো। প্রসাবের রং ছিল লাল। এবং পেটের দুই পাশ দিয়ে দুইটি পাইপ ঝুলানো ছিল।
সেখান দিয়ে বিভিন্ন রকমের ময়লা আসতো। পেটের ভিতরে পাইপ থাকায় নাকে অনেক বাজে ধরনের গন্ধ আসতো।এতো পরিমান থুথু আসতো মুখ দিয়ে যে, দুই সেকেন্ড পর পরে টিস্যু দিয়ে থুতু ফেলে মুখ মুছতে হতো। হাসপাতালে একজন আধা বয়স্ক মহিলা ছিল। তিনি আমাকে তার ছেলের মতো করে কিছুটা হলেও সেবা যত্ন করেছিলেন। তিনি রুমাল ভিজিয়ে আমার হাত, পা মুছিয়ে দিতেন। এতে করে অনেকটা আরাম হতো।সেই আধা পরিস্কার মহিলাটির এ আচরণে আমি অনেক মুগ্ধ হয়েছিলাম।আমার সব সময় অনেক ঠান্ডা লাগতো। আমার বাবা আমার হাতে, পায়ে, মাথায় তেল মালিশ করে দিতেন।
যার ফলে কিছুটা ঠান্ডা কমতো। সব সময় গায়ের উপরে চাদর দিয়ে থাকতে হতো। মানসিকভাবে এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে, প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতাম আমাকে একটি না একটি করে গুলি লাগে। কোনোদিন স্বপ্নে দেখি আমার পায়ে গুলি লাগছে, কোনোদিন দেখি পেটে, কোনোদিন দেখি হাতে! আবার অনেকদিন স্বপ্নে দেখতাম কোন একটা বড় গর্তের ভিতরে পড়ে যাচ্ছি। ১৭ ৯ দিন পেরিয়ে ডাক্তার পরিদর্শনে আসলে আমাকে পানি খাওয়াতে বললেন, বড়ই আশ্চর্যজনক বিষয় যে,পানির জন্য এতদিন ধরে এত ছটফট করতে ছিলাম অথচ দুই চামচ পানি খেয়ে আমার পানির পিপাসা মিটে গিয়েছিল। তারপর ডাক্তার বলেছিলেন যে,৫০০ মিলি পানি খেতে। মূলত পানি খেতে বলার কারণ তারা দেখতে চেয়েছিল যে, নাকের ঐ পাইপটা দিয়ে পানি আসে কিনা? পরের দিন তারা এসে দেখলেন যে, না, পাইপটিতে কোন প্রকার পানি আসেনি।
তখন ডাক্তার সেখানকার নার্সকে আমার নাক দিয়ে পেটের ভেতরে থাকা পাইপটি খুলে দিতে বলায়,নার্স আমার পাইপটি খুলে দেয়। যার ফলে শান্তি মতো নিশ্বাস নিতে পারতে ছিলাম। আমার বাবা এবং সহপাঠীদের অনেক কষ্ট করে সেই হাসপাতালে থাকতে হতো। কারণ সেখানে একটা মাত্র বিছানা যেটাতে রোগী থাকে।
রোগীর সেবা করার জন্য যারা থাকে তাদের জন্য রাতে কোন থাকার ব্যবস্থা নেই। তাই তারা মেঝেতে কিছু একটা বিছিয়ে থাকতেন। দেশের পরিস্থিতি অনেকটা খারাপ থাকার ফলেও এবং দেশে কারফিউ জারি থাকা সত্ত্বেও আমাকে দেখতে আমার আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাইয়েরা এসেছিলেন। দশ দিন পার হলে আমাকে ফলের রস,সুপ এগুলো খেতে বলা হয়। যার কারনে আমি মালটা এর রস এবং সুপ খাচ্ছিলাম। শরীরে কিছুটা শক্তির সঞ্চার হচ্ছিল।
১৮ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগীদের দেখতে আসবেন।তাই আমাদের ওয়ার্ডের সিট পরিবর্তন করে সকল গুলিবিদ্ধ রোগীকে একটি ওয়ার্ডে রাখা হল। সকল গুলিবিদ্ধ রোগীদের জন্য আলাদা একটি ওয়ার্ড তৈরি করা হলো। আমি হালকা খেতে পাচ্ছিলাম। তাই আমাকে স্যালাইনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র এন্টিবায়োটিক স্যালাইনটি দেওয়া হচ্ছিল। বিভিন্ন ঔষধ খেতে দেয়া হচ্ছিল আমাকে। হাসপাতালের ডাক্তার,নার্স এবং অন্যান্য কর্মীরা আমার খোঁজখবর নিতে আসতেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে অনেক ভালো লাগতো। ফলমূল খাচ্ছিলাম, এক পর্যায়ে ডাক্তার যখন ভাত খেতে নির্দেশ দিলেন তখন এক চামচ করে ভাত খাওয়া শুরু করলাম। কারণ অপারেশন করায় পেটে অনেকটা জায়গা সংকোচন হয়ে আসছে। সাবেক প্রধানমন্ত্ৰী আসতে চাওয়ায় গোছালো প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান করা হচ্ছিল।৩০ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আসার কথা ছিল তবে,আন্দোলনের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় আসেনি। এভাবে ২ আগস্ট পর্যন্ত আসার নাটক করতে ছিল। আমাদের ওয়ার্ড টি বিভিন্নভাবে গোছানো হচ্ছিল। ১আগস্ট এ আমার হাতের প্লাস্টারটি খোলা হয়।
খোলার পর দেখা যাচ্ছিল আগের চেয়ে কিছুটা মাংস পূরণ হয়েছে। ১৯ সেদিন থেকে হাতের ড্রেসিং শুরু হয়ে গেল। প্ৰথম দিন ড্রেসিং করতে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। গুলির আঘাত প্রাপ্ত স্থানে অনেক ধরনের সুতা আটকে ছিল, আরো কিছু পয়জন ছিল।যার কারনে অনেক জোরে জোরে ঠাসা দিয়ে ড্রেসিং করতে হয়েছিল। একটু পরে ডাক্তার এসে আমার প্রসাবের নালীতে থাকা পাইপ টিউবটি খুলে দেন। পাইপটি খুলতে প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল। কারণ পাইপটি ধীরে ধীরে নরম থেকে অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছিল।ঐদিন আমার প্রচুর কষ্ট হয়েছিল সবদিক দিয়েই।পরের দিন ২ আগস্ট এ সকালবেলা ডাক্তার পরিদর্শনে আসলে, আমার পেটের সেলাইয়ের উপরের ব্যান্ডেজ এর এক পার্শ্বে ধরে এক টানে পুরোটাই খুলে দিলেন। অপারেশন করা জায়গাটি অনেকটা শুকিয়ে এসেছিল।
তাই ডাক্তার বললেন, “আমার পেটের উপরের সেলাই গুলো খুলে দিতে। ” তার কিছুক্ষণ পরে আমার পেটের মাঝ বরাবর লম্বা যে জায়গায়টি কাটা হয়েছিল সেই সেলাইটি খুলে দেওয়া হলো। আর প্রথমে বুকের নিচে যেখানে বুলেট লেগেছিল সেই জায়গার অংশটুকু পুরোপুরি শুকায়নি যার ফলে ওইদিন সেই সেলাইটি কাটেনি। দেখতে দেখতে সেই দিনটি ও কেটে গেল। সারাদিন সেনাবাহিনী তাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। সেই ওয়ার্ডে যা কিছু পুরাতন ছিল সবকিছু নতুন করে লাগানো হচ্ছিল। ওয়ার্ড কে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছিল। ২০ আজ ৩ আগস্ট ২০২৪। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই, বিভিন্ন ধরনের চেকআপের জন্য সেনাবাহিনী(ARMY), র্যা ব (RAB), সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রধান নিরাপত্তা বাহিনী এস এস এফ (SSF) নানা রকমের যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। কোন প্রকার মেটালের জিনিস ওইদিন ওয়ার্ডে রাখতে দেওয়া হয়নি। ফল কাটা ছুরি তো দূরের কথা এমনকি একটি মেটালের চামচ পর্যন্ত রাখতে দেয়া হয়নি।তবে প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে নেওয়া সব জিনিসপত্র দিয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে আমাদের প্রত্যেকের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাইল তৈরি করা হয়েছিল। যাতে বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রদানকৃত ছিল। প্রত্যেকের একটি করে ছবি তোলা হয়েছিল। বিছানার সামনে একটি করে ছোট টেবিলে রাখা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় যেটি তৈরি করা হয়েছিল একটি কাগজে। যাতে করে এসেই দেখতে পান সেই রোগীটি আসলে কিভাবে আহত হয়েছে? কোন প্রতিষ্ঠানে সে পড়ালেখা করে? এরকম আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা তুলে ধরা হয়েছিল সেই কাগজে। এর আগের দিনগুলোতে হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মীরাও এ কাজগুলো তো অংশগ্রহণ করেছিলে। তবে আজ শুধুমাত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্বারায় সবকিছু সম্পাদন করা হচ্ছিল। একপর্যায়ে তাদের সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলো।
অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হলো সেই হাসপাতালে। যে দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঢুকবেন সে দরজাতে চেকপোস্ট বসানো হলো। ২১ হাসপাতালের নিচেও অনেক নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুপুর ১ টা নাগাদ তাদের সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।প্রধানমন্ত্রী আসার কথা ছিল তিনটার দিকে। হাসপাতালে সবাই চুপ কোন ধরনের একটা “টু শব্দ নাই!” এ পরিস্থিতিতে কোন ধরনের খাবার খাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে ক্ষুধা লেগে যায়। যাই হোক, তখন বাজে বিকাল পাঁচটা!
কড়া নিরাপত্তার ভেতর দিয়ে চোরের মত করে প্রবেশ করেন সেই হাসপাতালে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দরজা দিয়ে প্রবেশের পরই একটি রোগীর কাছে গেলেন। তাদের নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক রোগীর কাছে একজন করে অভিভাবক ছিলেন। প্রথম রোগীরসাথে তিন- চার মিনিট কথা বলার পর আমার কাছে আসলেন।আমি দ্বিতীয় নম্বর বিছানায় ছিলাম। আসার পরে আমাকে নির্লজ্জের মত জিজ্ঞেস করেছিল,“ বাবা কেমন আছো তুমি?সুস্থ আছো তো?”আমার তখন মনে হচ্ছিল যে, “যদি আমার কাছে শক্তি থাকতো তাহলে সেই খুনি হাসিনাকে সেখানেই মেরে ফেলতাম। ”“কারণ যে আমার এই অবস্থা করেছে, যে আমাকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে সে আমার কাছে কিভাবে জানতে চায় যে আমি কেমন আছি? " কিছু করতে পারবো না তাই দুঃখজনকভাবে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। ” ২২ এরপরে সে আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কয় সন্তান? ”আমার বাবা সঠিকভাবেই তার প্রশ্নের উত্তরটি দিলেন। তারপর সে আমার বাবাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলল, “এটা দিয়ে ওর চিকিৎসা করাইও। "আমার বাবার তাকে স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছিলেন যে,“ টাকা বড় কথা নয়, সু চিকিৎসাই আমাদের কাম্য। ”অনেকটা অপমান বোধ মনে করে সে ওখান থেকে চলে গেল। খুনি হাসিনাকে“ সে, বা তুমি বলার কারণ হচ্ছে তাকে আমার প্রচন্ড ঘৃণা লাগে।”
তখন আমার শরীরে শুধু দাউদাউ করে রাগের আগুন জ্বলতে ছিল তখন। ওর সাথে আমার কোন কথা বলার ইচ্ছে জাগেনি।তারপর একে একে সে ওই ওয়ার্ডের ১৮ জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এবং প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দেয়।আমার কথা হচ্ছে,“একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি এত মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার রোগীদেরকে দেওয়ার মতো শুধুমাত্র দশ হাজার টাকার রয়েছে?”“নাকি সে এখানে অভিনয় করতে এসেছে? ” হ্যাঁ, কিছুক্ষণ পরে তার অভিনয় শুরু হয়ে গেল! কয়েকজন রোগীর কাছে গিয়ে সে অভিনয়ের কান্না শুরু করে দিল!সেখানে কিছু স্বাৰ্থ লোভী অভিভাবক ছিল,যারা স্বার্থ হাসিলের জন্য তার কাছে মায়া কান্না শুরু করে দেয়।কিন্তু এতে তারা কোন ফল পাইনি,পাওয়ার কথাওনা ।
ঐদিন খুনি হাসিনার সঙ্গে এসেছিলেন, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ সামন্ত লাল, তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া, খুনি হাসিনার স্পেশাল ফোর্স SSE,RAB,প্যারা কমান্ডো,উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা, নৌবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তা, এবং প্রেসের অসংখ্য লোক। সেদিন তারা আমাকে নানারকমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। সরকার পক্ষের একজন লোক আমাকে বলল, “তুমি থাকো কোথায়?আমি বললাম, টঙ্গীতে। তখন সে পুনরায় বলল, টঙ্গী থেকে উত্তরা কি তামাশা করতে এসেছো? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো তোমরা? ”তখন এই প্রশ্নের কি জবাব দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
যার কারণে চুপ ছিলাম। বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তারা আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য? খুনি হাসিনার গোলামরা নানাভাবে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। আমি এত গুরুতর অসুস্থ ছিলাম যে, তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত আমার শক্তি ছিল না আমার মুখে। বিছানায় শুয়ে যতটুক পেরেছি তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম । ২৪ একপর্যায়ে এসে তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিবন্ধী ডা. রোকেয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেছিল,“তোমরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর বাবা? দেশকে ভালবাসতে হয়,দেশের জন্য কাজ করতে হয়।”আমি তখন হাসবো না কান্না করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, সে আমাকে শিখাচ্ছে কিভাবে দেশকে ভালবাসতে হয়?
যে দেশের সকল প্রকার দুর্নীতি দূর করার জন্য,ফ্যাসিস্ট রাজনীতি দূর করার জন্য, দেশের ভিতরে সকল প্রকার অত্যাচার নির্যাতন জুলুম দূরীকরণের জন্য আমরা দেশের সর্বস্তরের জনগণ আন্দোলন করে রাজপথে নেমে নিজের জীবনের পরোয়ানা করে অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছিলাম। এগুলো তাদের কাছে কোন দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়? দেশ প্ৰেম নয়?তাদের কাছে দেশপ্রেম হচ্ছে জোর করে ক্ষমতা দখল করে টিকে থাকার নামই দেশপ্রেম। ফিরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ক্যামেরার সামনে এসে অভিনয়ের কান্না করে চলে গেল সেই ফ্যাসিস্ট সরকার খুনি হাসিনা। সেদিন বুঝে গেছিলাম যে, তারা কোন কাজ করুক বা না করুক মিডিয়ার সামনে তাদের কাজ ঠিকই করে ফেলে? মিডিয়ার কাজ সম্পন্ন করে তারা সবাই সেখান থেকে চলে যায়। ২৫ প্রতিনিয়ত হাত এবং পেটে ড্রেসিং করা হচ্ছিল। হালকাভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে ছিলাম।
অন্যের সাহায্য নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেছিলাম। কিছুদিন পর এক পর্যায়ে নিজে নিজে হেঁটে বেড়াতে সক্ষম হই। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল হাসপাতালের দিনগুলো। আজ ৫ আগস্ট ২০২৪, শুনতে পেলাম সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন। এই খবর শোনার পর থেকে নিজের চোখ কান খোলা রাখতেছিলাম যাবতীয় সব নিউজ আপডেট পেতে। তৎকালীন তথ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সারা দেশের ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছিল।এর আগেও তারা বহুদিন নেটওয়ার্ক সার্ভিস বন্ধ রেখেছিল। বিভিন্ন জায়গার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু তারা এটা স্বীকার করেনি যে, তারা এই কাজটি করেছিল?তারা বলেছিল,“ আমরা ইন্টারনেট বন্ধু করিনি? ইন্টারনেট আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে?” যাইহোক তাদের এসব মিথ্যা,বানোয়াট কথায় কান দেওয়ার মত সময় আমাদের ছিল না। “লংমার্চ টু ঢাকা” এর ডাক দেয়া হয়েছিল। সারাদেশের সর্বস্তরের জনগণ ৫ ই আগস্ট পুরো রাজধানী ঢাকায় তারা এই জানান দিয়েছিল যে, “যদি এই দেশের ছাত্রসমাজ একবার জেগে ওঠে,তাহলে এই দেশে কোন ফ্যাসিস্ট সরকারের আস্তানা টিকে থাকতে পারে না।
২৬ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দেখতে পাচ্ছিলাম যে,পুরো ঢাকা শহর নিমিষেই তার ওপর এতদিনের চেপে থাকা ফ্যাসিস্ট,দুর্নীতিবাজ খুনি শেখ হাসিনা সরকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশের সর্বস্তরের জনগণের ভিড় জমে ছিল পুরো ঢাকার শহরে। মুহূর্তের ভিতরে তারা সংসদ ভবন ঘেরাও করে নেয়। কিন্তু সংসদ ভবন ঘেরাও হওয়ার পূর্বে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান দেশের জনগণের সঙ্গে এক প্রকার বিশ্বাসঘাতা করে ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনাকে ৪৫ মিনিটের আলটিমেডাম দিয়েছিলেন।সেই সুযোগে খুনি হাসিনা তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। খুনি হাসিনার যাবতীয় সব কুকর্ম সম্পর্কে বলার তেমন কিছু নাই।
এ ব্যাপারে জাতির সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এতকিছু করার পরও সেই ফ্যাসিস্ট সরকার খুনী হাসিনাকে কিভাবে বাহিনীর লোকেরা এই দেশ থেকে পালাতে সহযোগিতা করেন? যাহোক, শেখ হাসিনার পালানোর খবর মুহুর্তের ভেতরে দেশে-বিদেশে প্রচার হয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ বাহিনী লাগাতার গুলি চালাচ্ছিল। সংসদ ভবনে পুলিশ অনেককে গুলি করে মেরে ফেলে। অনেকে গুরুতর আহত হয় সেদিন। সেদিন সারাদেশে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, মারামারি -হানাহানি, হয়রানি, বিভিন্ন ম্যাসাকারের ভেতর দিয়ে চলতেছিল। ২৭ এরই মধ্যে বেলা ৩ টায় সেনা প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন যে, আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। আমরা দেশে হওয়া হত্যাকাণ্ড সবগুলোর বিচার করব ইনশাআল্লাহ। আপনাদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হবে। আমি আপনাদেরকে এই কথা দিচ্ছি। আপনারা সকলে আমাকে সাহায্য করবেন। এরকম আরো অনেক ধরনের কথা বলেছিলেন।এগুলো সব ভিডিও ফুটেজ রয়েছে ইন্টারনেটে। সেনাপ্রধানের এরকম কথায় আস্থা পেয়েছিল দেশের সমস্ত জনগণ। সারাদেশ বিজয়ের উল্লাসে মেতে গেল। এই রাষ্ট্র দ্বিতীয় বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করল ৫ই আগস্ট ২০২৪ এ।
আমার শরীরের অবস্থা তখন পর্যন্ত এই যে, বিজয় উল্লাসে একটু যে মন খুলে হাসবো সেটাও হাসতে পারেনি। হাসতে গেলে পেটে প্রচুর চাপ লাগতো। হাসপাতালের প্রতিটি দিনই আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করেছি।সেই সৃষ্টিকর্তার কাছে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করেছি প্রতিদিন। প্রবাদে আছে,“চোরের দশ দিন গেরেস্ত এর একদিন। ”এ যেন তারই এক বাস্তব প্রমাণ। সারাদেশে মিষ্টির দোকানে কেনার মতনমিষ্টি অবশিষ্ট ছিল না। বাংলার মানুষ ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করেছে। শেখ হাসিনার পালানোর খবর শুনে আমাদের হাসপাতালে ডাক্তার, নার্সরা মিষ্টি বিতরণ করা শুরু করেছিল। সারাদেশে মুজিবের যত মূৰ্তি ছিল সব ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছিল।
কিন্তু এরই মাঝে সারাদেশে ছাত্রলীগ সাধারণ জনগণ এবং ছাত্র জনতার উপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছে, বিভিন্ন অস্ত্রাঘাত করেছে। যাকেই রাস্তায় পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। তারা ভেবেছিল যে, এটাই আমাদের শেষ চেষ্টা বাংলার জমিনে রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য। সেদিন সারাদেশে পুলিশ, ছাত্রলীগ অসংখ্য হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। কিন্তু তারপরের দিন ৬ আগস্ট থেকে ছাত্রলীগের একজন নেতা কর্মীও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা ইন্দুরের মত গর্তে ঢুকে গিয়েছিল। হাসপাতালে আমার পেটের সব ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছিল।কিছু ইনফেকশন হওয়ায় আবার ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল।সেই হাসপাতালে আমার যা চিকিৎসা ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই ডাক্তার আমাকে বারবার বলতেছিলেন, “তুমি কি চলে যাবা যদি যেতে চাও? তাহলে চলে যেতে পারো।”৬ই আগস্ট এ আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে আসি। তখনো আমি কারো সাপোর্ট ছাড়া একাই বিছানা থেকে শোয়া বা উঠতে পারি না।
আমার ডান হাতের রগ ছিঁড়ে যাওয়ায় আঙ্গুল গুলো কাজ করে না। এমনকি লিখতেও পারি না।হাতের চিকিৎসা ওই হাসপাতালে ছিল না। যার কারনে আমাকে অন্য হাসপাতালে এই চিকিৎসার জন্য ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। ঐদিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের কাছে যাই হাতের চিকিৎসা নিতে।তিনি ঐদিন কিছু টেস্ট দিয়েছিলেন। ২৯ রাত হয়ে যাওয়ায় ঐদিন টেস্ট করা যায়নি। সেই রাতে চাচার বাসায় থাকতে হয়েছিল। পরেরদিন মিরপুর ১০ এ টেস্টগুলো করে ডাক্তারের কাছে রিপোর্টগুলো দেখালে তিনি বললেন এটা সার্জারি করতে হবে। কারন আমার হাতের দুইটা আঙ্গুল কাজ করে না এবং একটা আঙ্গুল no response. অপারেশন করতে হবে, তাই আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে কিছু সময় চেয়ে নিলাম আমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসার জন্য। কারন, আমার গুলি লাগার পর থেকে আমার মাকে একটি বারের জন্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মাকে দেখার জন্য আমার মন ছটফট করতে ছিল। বাসায় ছোট তিনটা বোন আছে। তাদেরও অনেকদিন ধরে দেখিনা।
এলাকায় সবাই আমাদের অপেক্ষায় যে, কখন আমরা বাড়ি ফিরব? যার কারণে আমি এবং আমার বাবা ৭ তারিখে আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পরের দিন ৮ তারিখে আমাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোলাম।গাড়িটি আমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে থেমেছিল। গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই দেখিয মা এসে হাজির। গাড়িওয়ালাকে বিদায় দিয়ে আমরা বাড়িতে গেলাম।কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হলো আমাকে দেখাবার জন্য।আমার আহত হওয়ার কথা শুনে গ্রামের অসংখ্য মানুষ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন আমার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেছিলেন যেন আমাকে সেই মায়ের বুকে রেখে যান।
আল্লাহ হয়তোবা সেই দোয়াগুলো কবুল করে আমাকে এই পৃথিবীতে রেখে দিয়েছেন। কথায় আছে,“ রাখে আল্লাহ, মারে কে? ” গ্রামে ১০-১২ দিন ছিলাম। এমন কোন দিন বাকি যায়নি যেদিন আমাকে দেখতে কোন লোকজন আসেনি? প্রতিনিয়তই অসংখ্য লোকজন আমাকে দেখতে আসতেন।বাড়িতেও আমার হাতের এবং পেটে ড্রেসিং চলতেছিল।ডাক্তার বাড়িতে এসে আমাকে ড্রেসিং করে দিয়ে যেতেন।হাসপাতাল থেকে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন সেগুলো সেবন করতে ছিলাম।এক পর্যায়ে আবারো ঢাকা চলে আসলাম হাতের চিকিৎসার জন্য। আমরা চাচ্ছিলাম যে, এটা যেহেতু অনেক গুরুতর সমস্যা।
তাই উন্নতমানের চিকিৎসার মাধ্যমে অপারেশন করবো।১৫ দিন পর যে হাসপাতালে ছিলাম, কুর্মীটোলা হাসপাতালে ডাক্তার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করতে বলছিলেন। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তাদের পরামর্শ নিলাম। বিভিন্ন হাসপাতালে সবচেয়ে বেস্ট চিকিৎসা খুজতেছিলাম হাতের অপারেশনের জন্য। বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, গিয়েও কোন কাজ হয়নি। কারণ সেখানে এই হাতের চিকিৎসা ছিল না। বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে দেখিয়েছিলাম। তাদের ওখানে চিকিৎসা থাকলেও তারা অপারেশনের খরচ প্রায় ২লক্ষ টাকার মত চাচ্ছিল। ৩১ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত হয়েছিলেন তাদের জন্য বেশ কয়েকটি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সঙ্গে ঢাকার CMH (combined military hospital) এ আমাদের আন্দোলনকারীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে অনেক উন্নত মানের চিকিৎসার সরঞ্জামাদি সহ উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়। তাই সেখানে আমার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে আমার এই হাতের অবস্থা দেখিয়েছি। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতেছি।
২২ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখে আমার হাতের অপারেশন হবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করি যেন আমার হাতকে তিনি দ্রুত সুস্থ করে দেন। স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা করি। সবার কাছে আমার নিজের জন্য দোয়া কামনা করতেছি। সেই সঙ্গে বাঙালি রাষ্ট্রের বিকাশ সাধনের জন্য আমার কিছু উপদেশ রেখে কথা শেষ করবো।সেগুলো হচ্ছে, (১) রাষ্ট্রের ভেতরে সম্প্রীতি, ঐক্য বজায় রাখা। (২)বাংলাদেশকে একটি সুন্দর, সুশৃংখল, সমদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো। (৩)রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে ঐক্য বজায় রাখা (৪)দেশের ভিতরে হওয়ার সকল প্রকার দুর্নীতি বন্ধ করার বিশেষ চেষ্টা চালানো। (৫) শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের দিকে বিশেষ নজর দেয়া। (৬)আগামীতে যখনই দেশের ভিতরে যেকোনো প্রকার অত্যাচার নির্যাতন জুলুম সকল প্রকার কুকর্মের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানো। (৭) আগামীতে যেন এই ধরনের ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
-Mohammad Junaed