Skip to Content

সাজেক উপত্যকায়

৯ বছর আগের ঘটনা। পাহাড়ের সৌন্দর্য অবগাহনের জন্য সাজেক উপত্যকায় এসেছি। দুপুরের খাবারের পর খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে রুইলুই পাড়ার সেনাবাহিনীর গেস্টহাউসের পাশের পাথুরে বাগানে (স্টোন গার্ডেন) ঘুরছি। চমৎকার বাগান। বাগানের উল্টো দিকে ত্রিপুরা উপজাতিদের মন্দির। মন্দিরের সামনে একটি পুরোনো বটগাছ। বটগাছের তলা বাঁধানো।

বটতলায় খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যে–ই না উঠতে গেছি, তখনই গাছের ডালে বসা একটি ভাতশালিকের পাশে একই আকারের চকচকে কালো একটি পাখি এসে বসল। পাখিটি ভাতশালিকের জাতভাই। তবে পাহাড়ি এলাকা ছাড়া কখনোই ওদের একসঙ্গে দেখা যাবে না। কাজেই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দুটিকে একটি ফ্রেমে বন্দী করার জন্য যে–ই না ক্লিক করেছি, অমনি পাখিটি উড়াল দিল। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করেও পাখিটিকে ফিরে আসতে দেখলাম না। বিফল হয়ে চলে এলাম।

এরপর যতবার সাজেক গেছি, ততবারই বটতলায় গিয়েছি। প্রতিবার ভাতশালিকের দেখা পেলেও কালো পাখিটিকে কখনোই ওর পাশে দেখিনি। ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিচিকিৎসাবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের দেশ দেখা ভ্রমণের অংশ হিসেবে সাজেক এসে আবারও দুটি পাখিকে একসঙ্গে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না।

পরদিন ভোরে সাজেকের হেলিপ্যাড থেকে ঘুরে এসে জুম্মবি (অর্থ পাহাড়ি মেয়ে) রেস্তোরাঁয় নাশতা খাওয়ার জন্য ঢুকব, এমন সময় রেস্তোরাঁর উল্টো পাশের গাছে কালো পাখিটির ডাক শুনলাম। দ্রুত দৌড়ে ওখানে গেলাম। প্রায় ২০টি কালো পাখি বটের পাকা ফল খেতে গাছময় ব্যস্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশপাশে ওদের জাতভাইয়েরা বসে থাকলেও বটগাছে ওদের কেউ এল না। ফলে কালো পাখিগুলোর ছবি তুলতে পারলেও দুটি প্রজাতির ছবি এক ফ্রেমে তুলতে না পারার কষ্টটা কিন্তু রয়েই গেল।

ভাতশালিকের যে জাতভাইয়ের গল্প বললাম, সে আমাদের অতিপরিচিত কথা বলা ময়না। ইংরেজি নাম কমন হিল ময়না বা পাহাড়ি ময়না। এটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। স্টুরনিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Gracula religiosa। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দাটিকে মূলত এ দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায়।

ময়নার দেহের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৯ সেন্টিমিটার। ওজন ২১০ গ্রাম। একনজরে চকচকে কালো পাখি। সঙ্গে বেগুনি ও সবুজের আভা। ডানায় সাদা পট্টি। কালো মাথার পেছন দিকে ঝুলন্ত হলুদ লতিকা। ঠোঁট কমলা-হলুদ, ঠোঁটের আগা হলুদ। চোখ কালচে-বাদামি। পা সোনালি-হলুদ। পায়ের আঙুল হলুদ হলেও নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে কোনো পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কগুলোর পালক বড়গুলোর থেকে ফ্যাকাশে। কানের লতি হলদেটে সাদা ও ঝুলন্ত নয়। ঠোঁট ফিকে হলদেটে কমলা।

মিশ্র চিরবুজ বনের আবাসিক পাখিটি মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বন ও চা-বাগানের প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে। শাখাচারী ও দিবাচর পাখিটি একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। সচরাচর ন্যাড়া গাছের উঁচু ডালে বসে থাকে। গাছে গাছেই খাবার খোঁজে। সহজে মাটিতে নামে না। রসালো ও পাকা ফল, কুঁড়ি, ফুলের রেণু ও নির্যাস এবং পোকামাকড় মূল খাবার। গলার স্বর পরিবর্তনশীল, সচরাচর উচ্চস্বরে ‘টি-অং--টি-অং---’ শব্দে ডাকাডাকি করে। অন্য পাখির স্বর নকলে ওস্তাদ। চমৎকার শিস দেয়।

মার্চ থেকে জুলাই ওদের প্রজননকাল। এ সময় বন বা চা-বাগানের ধারে উঁচু গাছের কোটরে বা কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায় ঘাস, পালক ও আবর্জনা দিয়ে বাসা বানিয়ে দুই থেকে তিনটি নীল রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৫ থেকে ১৯ দিনে। আয়ুষ্কাল ১২ থেকে ১৫ বছর।

বটের ফল মুখে একটি ময়নাছবি: লেখক

দুর্লভ এই পাখির কথা নকল করতে পারার ক্ষমতাটিই বুনো পরিবেশে ওদের টিকে থাকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিকারিরা বন থেকে নিয়মিত ময়না ধরে পাখি বিক্রেতাদের সরবরাহ করছে। পোষা পাখি হিসেবে এ দেশে ময়নাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখনো পোষা পাখির বাজারে পাখিটির দেখা মেলে। যদিও ময়না এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা পাখি, কিন্তু দেশের বন্য প্রাণী আইনে ময়নাসহ সব বুনো পাখি পোষা নিষিদ্ধ। কাজেই সবার কাছে নিবেদন, পাখি পুষতে হলে বিদেশি কেজ বার্ড পালন করুন, বন থেকে দেশি পাখি ধরে এনে নয়। আমাদের বনের পাখি বেঁচে থাকুক প্রকৃতিতে।

আধুনিক জীবনযাত্রা