মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা: যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা
মধ্যপ্রাচ্য এখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জর্জরিত। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছেই। ইসরাইল একে একে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ শক্তি এবং তাদের সমর্থক শক্তিগুলোকে দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিকতম আঘাত লেগেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর ওপর, যিনি ৩০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছিলেন। ইসরাইলি বিমান হামলায় বৈরুতের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগেই হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানে রিমোট কন্ট্রোল বোমা হামলায় হত্যা করা হয়।
লেবাননে ইসরাইলি হামলায় ইতোমধ্যে ২,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। পাল্টা প্রতিরোধে ইরান ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনায় মিসাইল হামলা চালালেও ইসরাইলের "প্যাট্রিয়ট" ও "আয়রন ডোম" প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার প্রশাসনের শেষ সময়ে এসে ইসরাইলকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন। এ বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ৮.৭ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে। বাইডেনের যুদ্ধবিরতির আহ্বানও নেতানিয়াহু উপেক্ষা করে চলেছেন।
ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলের বর্বর হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও নারী। গাজার শহরগুলো একের পর এক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন স্থাপনাও বোমা হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের জীবন যেন এক অবিরাম দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। "ওয়াশিংটন পোস্ট"-এর একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে, যেখানে দেখা গেছে এক বাবা তার সন্তানের মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করছেন। শিশুটির মাথায় বোমার ধাতব অংশ বিদ্ধ।
পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলের এই আগ্রাসনকে সমর্থন জানাচ্ছে "আত্মরক্ষার অধিকার" বলে, অথচ ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে নীরব। ইরান, আয়ারল্যান্ড, ও স্পেন ছাড়া কোনো দেশই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সরব নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব একাধিকবার ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস (আইসিজে) ইতোমধ্যে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে।
বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গাজায় চলমান নৃশংসতার তীব্র নিন্দা জানান এবং দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান করেন। তার মতে, টেকসই শান্তির একমাত্র পথ হলো দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে জোরদার হচ্ছে। ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমত দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইসরাইলের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে পারে। ফিলিস্তিনিরা যে আত্মসমর্পণ করবে না, সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্বনেতাদের দায়িত্ব হলো এই সংকটের সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
গাজায় এক বছরের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়
ইসরায়েলি আগ্রাসনের এক বছরে গাজার পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের অবিরাম হামলায় ৪১,৮৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৬,৭৬৫ জন শিশু এবং ১১,৩৪৬ জন নারী। আহত হয়েছেন ৯৭,০০০-এর বেশি মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০,০০০-এর বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
ইসরায়েলের হামলায় গাজার হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ ও গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। গাজার জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এই মুহূর্তে গাজা ভয়াবহ খাদ্য, পানি ও ওষুধ সংকটে ভুগছে। প্রায় ৬০ শতাংশ অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
মানবিক সংকট:
২০ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা এই জনগোষ্ঠী বর্তমানে এক চরম সংকটের মুখোমুখি। জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজায় চলমান এ পরিস্থিতিকে ইতিহাসের অন্যতম বড় মানবিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বেশি অনুভূত হচ্ছে।
যুদ্ধের আড়ালে পশ্চিম তীরে ভূমি দখলের নীরব অভিযান
গাজায় চলমান যুদ্ধের আড়ালে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল জোরদার করছে। ফিলিস্তিনের বাত্তির গ্রাম, যা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, বর্তমানে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের একটি নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন জলপাই বাগান ও আঙুরক্ষেত ঘেরা এই গ্রামে ইসরায়েল নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। এতে বহু ফিলিস্তিনির ব্যক্তিগত জমি জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে।
ভূমি দখল ও স্থানীয়দের দুর্দশা
ঘাসান ওলিয়ান, একজন স্থানীয় জমির মালিক, কষ্টের সঙ্গে বলেন, "নিজেদের স্বপ্ন গড়তে আমাদের জমি চুরি করছে ওরা।" বসতি স্থাপনের এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ হলেও ইসরায়েল তা মানতে নারাজ। ইউনেসকো এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সতর্কতা
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত-এর প্রধান রোনেন বার সম্প্রতি মন্ত্রীদের সতর্ক করে বলেছেন, পশ্চিম তীরে ইহুদি চরমপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, যা দেশকে “অবর্ণনীয় ক্ষতির” মুখে ফেলতে পারে।
যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার আশঙ্কা
ইসরায়েলের চরমপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বসতি স্থাপনকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে। "পিস নাও" সংস্থার ইয়োনাতান মিজরাহি বলেন, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিম তীরে জমি দখল ও বসতি স্থাপনের গতি বেড়েছে। ইসরায়েলি সমাজে ক্রোধ ও ভয়ের মিশ্রণ বসতি স্থাপনে ইন্ধন দিচ্ছে, আর দখলদারদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই।
জনমতের বিভাজন
এক জরিপ অনুযায়ী, ৪০% ইসরায়েলি মনে করেন, বসতি স্থাপন দেশের নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, যা ২০১৩ সালে ছিল ২৭%। তবে ৩৫% মানুষ মনে করেন, এতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ভূমি দখল ও বসতি স্থাপনকে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখছে। গাজায় যুদ্ধের ছায়ায় পশ্চিম তীরে ভূমি দখল ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য শুধু জমি নয়, তাদের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত করে তুলছে।