ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত একটি জটিল এবং দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। এটি ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, ভূরাজনীতি এবং উপনিবেশবাদের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ। সংঘাতের মূল কারণগুলোতে ভৌগোলিক অঞ্চল, ধর্মীয় পবিত্র স্থান, এবং দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী আবেগ জড়িত।
মূল ইতিহাসের ধাপসমূহ
১. অটোমান সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯১৭ সালের আগে)
- প্যালেস্টাইন দীর্ঘদিন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।
- এই অঞ্চলে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের বসবাস ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন মুসলমানরা।
২. বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭)
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানায়।
- এই ঘোষণায় মুসলিম আরবদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়, কারণ তারা নিজেদের ভূমি হারানোর আশঙ্কা করছিল।
৩. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯২০-১৯৪৮)
- ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে ব্রিটেন ফিলিস্তিন শাসনের অধিকার পায়।
- ইহুদিদের ব্যাপকভাবে ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইনে অভিবাসন শুরু হয়, যা আরবদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
- ১৯২৯ এবং ১৯৩৬ সালে আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, যেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা এবং ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদ করা হয়।
৪. ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৭-১৯৪৮)
- জাতিসংঘের প্রস্তাব (১৯৪৭): জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
- ইহুদিরা প্রস্তাবটি মেনে নেয়, কিন্তু আরবরা প্রত্যাখ্যান করে।
- ১৯৪৮ সালে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর পরপরই আরব দেশগুলো (মিশর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক) ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
- এই যুদ্ধের ফলে ইসরাইল তার ভূখণ্ড বাড়ায় এবং ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয় (যা নাকবা নামে পরিচিত)।
৫. ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ
- ইসরাইল মিশর, সিরিয়া এবং জর্দানের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে।
- এর ফলে ইসরাইল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, গোলান হাইটস, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
- এই দখল ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।
৬. পিএলও এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ (১৯৬৪-১৯৮৭)
- ১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন।
- PLO সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করে।
৭. প্রথম ইন্তিফাদা (১৯৮৭-১৯৯৩)
- গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি দখলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রথম গণ-আন্দোলন।
- এই সময় প্যালেস্টাইনের জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে, যা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
৮. ওসলো চুক্তি (১৯৯৩-১৯৯৫)
- ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম বড় পদক্ষেপ।
- PLO ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে, এবং ইসরাইল ফিলিস্তিনি স্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মত হয়।
- তবে এই চুক্তি বাস্তবায়নে বড় বাধা তৈরি হয়, এবং দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা ক্ষীণ হয়ে যায়।
৯. দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০-২০০৫)
- ওসলো চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা আবারও ব্যাপক আন্দোলনে অংশ নেয়।
- এই সময়ে সংঘাত আরও সহিংস হয়ে ওঠে, এবং উভয় পক্ষই বিপুল প্রাণহানি ভোগ করে।
১০. গাজা সংকট (২০০৭-বর্তমান)
- ২০০৭ সালে হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর পর থেকে ইসরাইল গাজা অবরোধ করে রাখে।
- গাজা থেকে রকেট হামলা এবং ইসরাইলি বিমান হামলা নিয়মিত ঘটছে।
- এই সংঘাতে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক নিহত এবং আহত হয়েছে।
মৌলিক বিরোধের বিষয়গুলো
- ভূখণ্ডের দখল ও সীমানা: ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চল (পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা) ফিলিস্তিনিরা তাদের রাষ্ট্রের জন্য চায়।
- শরণার্থী সমস্যা: ১৯৪৮ এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার।
- জেরুজালেম: উভয় পক্ষই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী দাবি করে।
- ইহুদি বসতি: পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতিস্থাপন ফিলিস্তিনিরা অবৈধ বলে মনে করে।
- নিরাপত্তা: ইসরাইল তার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, যা প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের অধিকার হ্রাসের কারণ হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি
- সংঘাত থামানোর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান এখনও অনিশ্চিত।
- দুই-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হলেও তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
- গাজা এবং পশ্চিম তীরে অবস্থা এখনও অত্যন্ত অস্থির।