প্রতিবেদক: বার্তা সম্পাদক
নিঝুম দ্বীপ, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত একটি অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে ম্যানগ্রোভ বন, বর্ণিল পাখির কলকাকলি, এবং অগণিত চিত্রা হরিণের অবাধ বিচরণ দ্বীপটিকে করে তুলেছে বিশেষ এবং পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এই সৌন্দর্যের পেছনে বর্তমানে লুকিয়ে আছে গভীর সংকট। আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে দ্বীপের চিত্রা হরিণের সংখ্যা এবং বাড়ছে তাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের সংকট।
১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে নিঝুম দ্বীপে মাত্র ৪ জোড়া চিত্রা হরিণ অবমুক্ত করা হয়েছিল। ধীরে ধীরে এদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং বর্তমানে দ্বীপে প্রায় এক লক্ষ হরিণ রয়েছে। বিশাল সংখ্যা হলেও খাদ্য সংকট, আবাসস্থলের ধ্বংস এবং অবৈধ শিকারের কারণে চিত্রা হরিণের ভবিষ্যৎ বর্তমানে বিপন্ন। **
দ্বীপের হরিণসংখ্যা রক্ষার লক্ষ্যে বন বিভাগের নতুন বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তা জোয়ারে ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ফলে খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে।
নিঝুম দ্বীপের পরিবেশকে রক্ষা করতে ম্যানগ্রোভ বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্বীপের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এ কারণে হরিণের নিরাপদ আশ্রয় এবং খাদ্য সংরক্ষণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বনভূমি ধ্বংস করে কৃষি সম্প্রসারণ, ঘরবাড়ি নির্মাণ, এবং কাঠ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা হরিণের জন্য আবাসস্থল সংকট তৈরি করছে।
দ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে ভূমিদস্যু এবং বনদস্যুরা নিয়মিত কাঠ পাচার করছে। অভিযোগ রয়েছে যে, স্থানীয় বন বিভাগের কিছু কর্মচারীর সহযোগিতায় এই বন ধ্বংস এবং অবৈধ শিকার চলছে। রাতে বনভূমিতে ঢুকে জাল পেতে চিত্রা হরিণ শিকার করা হচ্ছে, যা এই প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বনের সুরক্ষামূলক বাঁধগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দ্বীপে মিষ্টি পানির অভাবও রয়েছে, যা হরিণের জন্য খাদ্য সংগ্রহের বড় চ্যালেঞ্জ।
নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বীপে পর্যটনের উন্নতির লক্ষ্যে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদ্যোগ প্রয়োজন। দ্বীপের চিত্রা হরিণের জীবনধারা সংরক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট ডিয়ার জোন (হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র) প্রতিষ্ঠা এবং পর্যটকদের জন্য কাঠের রাস্তা কিংবা ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে পর্যটনের মাধ্যমে আয়ের পাশাপাশি হরিণ সংরক্ষণের জন্য তহবিলও সংগ্রহ করা যাবে।
নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করে এবং গ্লোবাল পজেশন সিস্টেম (GPS) সার্ভের মাধ্যমে জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি নির্ধারণ করা জরুরি। এ ছাড়া হরিণের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বনায়ন এবং স্থানীয় জনগণকে বন সংরক্ষণে অংশীদার করা প্রয়োজন। প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় বনরক্ষা, হরিণের আশ্রয় নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
নিঝুম দ্বীপের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী এবং স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করাই হতে পারে চিত্রা হরিণের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়। নিঝুম দ্বীপের এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর মনিটরিং, এবং পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন জরুরি।
পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে নিঝুম দ্বীপকে একটি টেকসই পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া জরুরি, যা দেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণের পথকে আরও প্রশস্ত করবে।